ট্যাকা হারাইছে

এ.টি.এম.ফয়সাল রাব্বি রাকিব:“ভাই,কয়টা বাজে?”-তার সময় জানা খুব জরুরী। দিনশেষে,তার রাতের খাবারের অর্থটুকু তাকে আয় করতে হবে। তাইতো, ছাত্রের মত সময়মানুবর্তীতার অনুশীলন করতে হয় তাকেও।
ব্যাস্ত নগরী। জীবীকার উদ্দেশ্যে বিরামহীন চলছে শহুরে কর্মকাণ্ড।সেখানকার কর্মকাণ্ড বেশিই ব্যস্ত আর অসস্তিকর বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে কিছু অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ততার,কিছু করুন ছিল আমার কাছে।
গত মাসে গিয়েছিলাম ঢাকায়। উদ্দেশ্য ছিল অপারেশন, ঘোরা। জীবীকার তাগিদে যে কতজন কত বিচিত্র পেশা গ্রহন করতে পারে তার বৈচিত্রতা ঢাকায় না গেলে দেখা হত না। সবচেয়ে বৈচিত্রময় পেশা মনে হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি।  ভিক্ষা করার ধরন, কৌশল উল্লেখকরার মত। ভিক্ষাবৃত্তিকে ব্যবসা বলা যেতে পারে। বিনা ইনভেস্টমেন্ট এ মুনাফা পুরাটাই।
ফার্মগেট, সেজান পয়েন্টের কাছে ফ্লাইওভারটা পার হচ্ছি। এক পিচ্চি পংগু বাচ্চা ক্ষপ করে ধরে ফেলল পা। কিছুতেই ছাড়বেনা,টাকা না দিলে। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে করুনা হচ্ছিল, করুনা হওয়াও স্বাভাবিক। করুনার সাথে তীক্তও হচ্ছিলাম। অবাকও হচ্ছিলাম, এতোটুকু শিশু কি করে এমন কৌশলী ভিক্ষুক হয়ে উঠল? ভিক্ষাবৃত্তিকে দোষ দিচ্ছি না,কারন কোনো পথ না পেয়েই তারা ভিক্ষাবৃত্তি করছে, কিন্তু দোষ দিচ্ছি তাদের টাকা আদায়ের কৌশলটাকে,দেখে মনে হয় তারা ভিক্ষা করায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সেখানকার সবাই বিভিন্নভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী, দেখেই বোঝা যায় প্রতিবন্ধকতা জন্মগত নয়। এক্ষেত্রে, একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, তারা কি আসলেই ভিক্ষা করছে?  নাকি তাদের দ্বারা ভিক্ষা করানো হচ্ছে……?
সাভারের, জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সেখানেও একই অভিজ্ঞতার স্বীকার হতে হল। টাকা না দিলে কিছুতেই পিছু ছাড়বে না একদল শিশু। এক্ষেত্রে পূর্বেকার উত্তোলিত প্রশ্নটি আবার জেগে ওঠে তারা কি ভিক্ষা করছে? নাকি করানো হচ্ছে…?

এসব অভিজ্ঞতা ছিল তীক্ততার অভিজ্ঞতা, মনে ততটা নাড়া দেয় না।
যে অভিজ্ঞতায়, আজও আমি মর্মাহত, সেটা বলছি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, মীর মোশারফ হলের সামন দিয়ে যাচ্ছি। ছোট এক বাচ্চা ছেলে আমায় জিজ্ঞেস করল ভাই কয়টা বাজে? তার দিকে ততটা মনোযোগ না দিয়ে বললাম, সাড়ে বারটা। বাচ্চাটার বয়স ৫-৬ বছরের বেশি না, আমার ভাগনীর বয়সী।  পড়নে হাফপ্যান্ট, ময়লা গেঞ্জি। হাতে চায়ের ফ্ল্যাক্স। সে একজন চা বিক্রেতা। আমার ভাগনীর আজ সকল মৌলিক চাহিদার পাশাপাশি সকল আবদার পূরন হচ্ছে, আর সে বাচ্চাটা গরীবঘরে জন্মেছে বলে ২ বেলা খাবার খাওয়ার জন্য আয় করতে হয়। একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এই যে, কেউ গরীব ঘরে, আবার কেউ ধনী ঘরে জন্মায় সেটা খুব গোজামিল সিস্টেম মনে হয় আমার কাছে। শুধুমাত্র জন্মের পরিবারের ভিন্নতার কারনে কারোও বাবা-মা অপেক্ষা করেন, কখন তার সন্তান আবদার করবে, আর কখন সে মুখ ফুটে হাসবে। আর কারো বাবা-মা অপেক্ষা করেন কখন তার সন্তান চা বিক্রি শেশে রোজগারের টাকা এনে দেবে। সবই জন্মের দোষ।  জন্ম? সেও তো বিধাতার হাতে।
বাচ্চাটা চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মনে হল, বাচ্চাটি কাঁদছিল। পিছন ফিরে বাচ্চাটি থামালাম। জিজ্ঞেস করলাম কান্নার কারন। কেঁদে বলল,”ভাই, ট্যাকা হারাইছে”। বলে সে আবার দ্রুত হাটা শুরু করল, দিনশেষে যে তাকে খাবারের টাকা জোগাতেই হবে। নইলে, অভূক্ত থাকতে হবে সারারাত। ক্ষুধা? সেও তো বিধাতা প্রদত্ত। কেউ পেট ভরে খেতে চায় বাচার জন্য, কেউবা ভরা পেটে যায় দামি রেস্টুরেন্ট এ আদিক্ষেতা করতে। চা বিক্রেতা বাচ্চাটাকে আবার থামিয়ে ২০ টাকা হাতে দিলাম,দেওয়ার জন্য এটাই সম্বল ছিল আমার।  হয়ত ২০টাকায় সে একবেলা খেতে পারবে। আমি চকচকে প্যান্ট -শার্ট পড়ে হাটছি, ঘুরছি, বিনোদন করছি,বাপের টাকায় আদিক্ষেতার সব কিছুই করছি, আর আমারই এলাকায়, আমারই সমাজে, আমারই দেশে একটা অর্ধ উলঙ্গ শিশু ২ বেলা খেয়ে বেচে থাকার জন্য চা বিক্রেতার কাজ করে। সেই মুহুর্তটুকু নিজেকে বড় ধরনের অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমি জানি, এসব শিশুদের শিক্ষা ও অধিকারের জন্য সরকারি নানা ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। আমরা এনসিটিএফও শিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। তারপরও, একটা চিরন্তন প্রশ্ন থেকেই যায়, আর কতদিন এরকম শিশুকে দেখতে হবে?